The blast in Beirut, Lebanon

 



গত ৪ আগস্ট লেবাননের রাজধানী বৈরুতে স্থানীয় সময় বিকেল ৬ টায় ঘটে এক ভয়াবহ বিস্ফোরণ। প্রাথমিক ভাবে ধারণা করা হচ্ছে ,সমুদ্র বন্দরের গুদামে থাকা দাহ্য রাসায়নিক পদার্থ থেকে বিস্ফোরণটি ঘটতে পারে বৈরুতের এই মানবসৃষ্ট দুর্যোগটি সম্পর্কে আজ আমি লিখবো ।

 


  

                     


লেবাননের রাজধানীর বন্দরে সেদিন প্রথমে বিশাল অগ্নিকাণ্ড ও প্রচুর ধোঁয়া দেখা যায় । বন্দরে যে গুদামে আগুন লেগেছিল তার মধ্যে ছিল আতশবাজি ও অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট এর মতো রাসায়নিক । প্রথমে আতশবাজির মধ্যে ছোট্ট একটি বিস্ফোরণ ঘটে। এসময় আগুন আর ধোঁয়ার মধ্যে আতশবাজির আলোর ঝলক দেখা যায় । তার কিছুক্ষন পরেই ঘটে ভয়াবহ বিস্ফোরণ যার তীব্রতা ছিল ৩.৫ মাত্রার ভূমিকম্পের সমান । বিস্ফোরণের ফলে ৫ কিমি এলাকা জুড়ে সম্পূর্ণ লণ্ডভণ্ড হয়ে যায় । ১১ কিমি দূর হতেও এ বিস্ফোরণ দেখা যায় এবং ১৫ কিমি দূর পর্যন্ত বিস্ফোরণের তরঙ্গ আঘাত করে। এমনকি বৈরুত থেকে প্রায় ২৪০ কিমি দূরের দেশ সাইপ্রাসেও এ  বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। সেই সাথে সাইপ্রাস দ্বীপ ভূমিকম্পের মতো কেঁপে ওঠে। এ থেকেই দুর্ঘটনার ভয়াবহতা আঁচ করা যায়। 

 বিস্ফোরণের ফলে কমপক্ষে ১৭০ জন নিহত হন। আহত হন প্রায় ছয় হাজার মানুষ। জাতিসংঘের শিশু তহবিল ইউনিসেফ জানিয়েছে, কমপক্ষে ৩১টি শিশু প্রাণ হারিয়েছে এই বিস্ফোরণে। যে গুদামে বিস্ফোরণেটি ঘটে সেখানে তৈরি হয়েছে এক বিশাল গর্ত। এছাড়া বৈরুত শহরের বিশাল অংশ সম্পূর্ণ ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়েছে। শহর জুড়ে বহু ভবনের জানালা দরজা ভেঙ্গে গেছে। এবং রাস্তায় থাকা অসংখ্য গাড়ি রীতিমতো দুমড়ে মুচড়ে আছে। এতো বিপুল পরিমাণ ঘরবাড়ি ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে যে প্রায় ৩ লক্ষাধিক লোক গৃহহীন হয়ে পরেছে।  বিস্ফোরণে হতাহত হয়েছেন অনেক মানুষ। সেই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়েছিলেন বাংলাদেশি তরুণ জুবায়ের কবির।প্রথম আলোয় তার লেখা অভিজ্ঞতায় তিনি সে সময়ের বর্ণনা দিয়ে লিখেছেন, 

 

          “ সন্ধ্যা তখন সাড়ে ছয়টা। সেদিন অফিসের কাজ শেষ করে বেরিয়েছিলাম। আনমনে হেঁটে বাসায় ফিরছিলাম। হঠাৎ বিকট শব্দে কেঁপে উঠল পৃথিবী। মনে হলো পায়ের নিচের মাটি চৌচির হয়ে যাচ্ছে। শহরটা হয়তো মাটির নিচে দেবে যাবে। ভূমিকম্প ভেবে মাথার ওপর দুই হাত রেখে নিরাপদ স্থানের খোঁজে দৌড় দিলাম। আশপাশে ফাঁকা জায়গা না পেয়ে রাস্তার মাঝখানে গিয়ে দাঁড়ালাম। পাশেই নির্মাণাধীন একটা ভবন ছিল। সেটি রীতিমতো দোল খাচ্ছিল। আশপাশের সব ভবনের কাচ ভেঙে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে নিচে পড়ছিল। কাচপতনে ধুলায় ভরে গেল চারপাশ। ওপরে তাকিয়ে দেখলাম ধোঁয়ার কুণ্ডলী।মনে হচ্ছিল, মৃত্যুকে যেন কাছ থেকে দেখছি।“ তিনি আরও জানান, “দূতাবাসের হিসাবে এখন পর্যন্ত ১০৮ জন বাংলাদেশি আহত হয়েছেন, মারা গেছেন ৫ জন।“


এছাড়া, বৈরুতের বিস্ফোরণে বাংলাদেশ নৌবাহিনীর ২১ সদস্য আহত এবং জাহাজের ক্ষতি সাধিত হয়েছে।

প্রথম আলো থেকে ১৩ আগস্ট,২০২০ “বৈরুতের শিশুরা ট্রমাগ্রস্ত ” শিরোনামে আমি একটি প্রতিবেদন পড়েছি যা নিম্নরূপ-

‘’আবেদ ইতানি। বয়স তিন বছর।  আগস্ট লেবাননের বৈরুতে যখন বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটেতখন সে খেল ছিল। কিন্তু এই বিস্ফোরণে তার ঘরের কাচের দরজা টুকরা টুকরা হয়ে যায়। আর এই কাচের টুকরা দিয়ে ইতানির হাতপা কেটে যায়। তারপর আহত অবস্থায় তাকে নেওয়া হয় হাসপাতালে। সেখানে জরুরি কক্ষে তখন অনেকেই ছিলেনযাঁরা আহত  রক্তাক্ত। ইতানি তাঁদের দেখেছিল। তারপর থেকে আর স্বাভাবিক আচরণ করছে না ইতানি।

এবিসি নিউজ  বার্তা সংস্থা এএফপির খবরে বলা হয়েছেইতানির মতো অনেকেই ট্রমাগ্রস্ত। শিশুদের স্বাস্থ্যশিক্ষাঅধিকার  অর্থনীতি নিয়ে কাজ করা যুক্তরাজ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংগঠন সেভ দ্য চিলড্রেনের হিসাব অনুসারেএই বিস্ফোরণে প্রায় এক লাখ শিশু গৃহহীন হয়েছে। এর মধ্যে একটি বড় অংশ ট্রমাগ্রস্ত।‘’

বৈরুত বন্দরে মজুদকত অ্যামোনিয়াম নাইট্রেটের কারণে বিস্ফোরণের তীব্রতা এতোটা বৃদ্ধি পেয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে । অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট মূলত সার উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। এছাড়া বহু শিল্পকারখানায় এর ব্যবহার আছে। এটি সরাসরি বিস্ফোরক পদার্থ নয়, তবে বিশেষ পরিস্থিতিতে এটি আগুন জ্বালতে সাহায্য করে। তাই, একে বলা হয় oxidizer, অর্থাৎ এটি আগুনে আরও অধিক পরিমাণ অক্সিজেন টেনে এনে আগুনকে আরও উসকে দেয়।

২০১৩ সালে একটি রাশিয়ান কার্গো জাহাজ ২৭৫০ টন অ্যামোনিয়াম নাইট্রেট সহ বৈরুত বন্দরে আসে। অপরিকল্পিত ভাবে বন্দরে ভিড়ার কারণে বন্দর কর্তৃপক্ষ জাহাজটি বাজেয়াপ্ত করে এবং জাহাজে থাকা বিশাল পরিমাণ রাসায়নিক পদার্থ বন্দরের ১২ নং গুদামে মজুদ করা হয়। দীর্ঘ ৭ বছরেও এই বাজেয়াপ্ত মালের কোন ব্যাবস্থা নেয়া হয়নি। মাত্র ৬ মাস আগে, ১২ নং গুদাম পরিদর্শন করে কর্মকর্তারা বলেছিলেন, “এখানে রীতিমত ভাসমান বোমা মজুদ করা হয়েছে”। তারা আশঙ্কা করেছিলেন এখানে দুর্ঘটনা ঘটলে পুরো বৈরুত শহর উড়ে যাবে। অবশেষে সেই আশঙ্কা সত্যি পরিণত হল। তবে অনেকেই একে দুর্ঘটনা নয়, হামলার শিকার হিসেবে দেখছেন।

এ বন্দরটি ছিল লেবাননের ৮৫% খাদ্যশস্যের ভাণ্ডার। এছাড়া এখানেই ছিল জরুরি খাদ্যের মজুদ। বিবিসি এর রিপোর্ট অনুসারে, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বলেছে, বিস্ফোরণের কারণে বৈরুত বন্দরে যে ক্ষতি হয়েছে, তাতে ওই বন্দর দিয়ে দেশটিতে খাদ্য সরবরাহ বিঘ্নিত হবে। এতে বেড়ে যাবে খাদ্যপণ্যের দাম। এছাড়া বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (WHO) বলেছে, বিস্ফোরণে তিনটি হাসপাতাল পুরোপুরি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এতে লেবাননের স্বাস্থ্যব্যবস্থা গভীরভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।

 দীর্ঘ দিন থেকে লেবাননের অর্থনীতি ভঙ্গুর প্রায় এবং এর অর্ধেক লোক ইতোমধ্যেই দারিদ্র্য সীমার নিচে বাস করছে। সাম্প্রতিক করোনা মহামারির কারণে দেশটির অর্থনীতি চরম সংকটের মধ্যদিয়ে যাচ্ছিল। এমনকি তাদের সরকারও ছিল দেউলিয়া হবার পথে। ফলে, জনগণের পক্ষে এই ভয়াবহ দুর্ঘটনা কাটিয়ে ওঠা মোটেই সহজ নয়। এ ধ্বংসযজ্ঞ সরিয়ে শহর পুনর্নির্মাণ করতে কয়েক হাজার কোটি টাকার দরকার হবে। তবে আলজাজিরার বিশ্লেষণ অনুযায়ী,  ‘ ছাইভস্মের ভেতর থেকে কীভাবে মাথা তুলে দাঁড়াতে হয়, বৈরুত নগরের তা জানা আছে। বলা হয়ে থাকে, এই শহর তার ৫ হাজার বছরের ইতিহাসে সাতবার ধ্বংস ও পুনর্নির্মিত হয়েছে। অতীতে এ নগরের ওপর দিয়ে যত যুদ্ধ, আগ্রাসন বা ভূমিকম্পের ধ্বংসলীলা ঘটেছে, সাম্প্রতিকতম বিপর্যয় যেন এগুলোর সব ছাপিয়ে গেছে। এর কারণ সম্ভবত এটি বাইরের কোনো বৈরী শক্তি বা প্রাকৃতিক ঘটনার ফল নয়, নিজ দেশের ক্ষমতাসীন অভিজাতদের ডেকে আনা বিপর্যয় এটি।‘

অনেক দেশ তাৎক্ষণিক সহায়তার জন্য সাহায্য পাঠাচ্ছে। দাতা রাষ্ট্রকে লেবাননের জনগণ বিভিন্ন এনজিও এর মাধ্যমে সহায়তা পাঠানোর আহ্বান জানাচ্ছে। কারণ জনগণ মনে করে লেবাননের দুর্নীতিগ্রস্থ রাজনীতিবিদ ও সরকারের কারণেই এমন ভয়াবহ বিস্ফোরণ ঘটেছে। তাই তারা চায়না এসব সহায়তা সরকারের কাছে পৌঁছাক। এমনকি এ বিস্ফোরণের কয়েক মাস আগে থেকেই, লেবানন সরকারের দুর্নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভ হচ্ছিল। আল জাজিরার পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী,

 ‘’বিস্ফোরণের ঘটনায় ধ্বংসযজ্ঞ ও জনরোষের সঙ্গে এখন ক্রমেই যুক্ত হচ্ছে লেবাননের অভ্যন্তরে থাকা বিদেশি শক্তিগুওলোর সম্পৃক্ততা। এটি লেবানন সরকারকে আরও দুর্বল করবে ও বিরাজমান দেশীয় রাজনৈতিক উত্তেজনায় ঘি ঢালবে। প্রধানমন্ত্রী হাসান দায়েব ও তাঁর সমর্থকেরা সাবেক প্রধানমন্ত্রী সাদ হারিরির প্রভাব কমানোর চেষ্টায় বিস্ফোরণের ঘটনাকে ব্যবহার করতে চাইবেন। বিপরীতে হারিরি দ্রুজ নেতা ওয়ালিদ জামব্লাতকে নিয়ে ক্ষমতাসীন সরকার ও প্রেসিডেন্টের বিরুদ্ধে প্রচারণা গতিশীল করার চেষ্টা চালাতে পারেন। লেবাননের দুর্নীতিগ্রস্ত রাজনৈতিক ব্যবস্থার আরেক প্রভাবশালী গোষ্ঠী হিজবুল্লাহও বসে থাকবে না। তারাও এই রাজনৈতিক উত্তেজনাকে নিজেদের প্রভাব বিস্তারে কাজে লাগানোর চেষ্টা চালাবে। ‘’

কাতারভিত্তিক আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম আল জাজিরার প্রতিবেদনে আরও জানানো হয় যে, গত মঙ্গলবার বৈরুত বন্দরে ভয়াবহ বিস্ফোরণের পর বিক্ষোভ প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিতে বিক্ষোভ শুরু হলে  প্রধানমন্ত্রী পদত্যাগ করতে বাধ্য হন। প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের ঘোষণা দেওয়ার আগে ১০ আগস্ট পদত্যাগ করেন লেবাননেরর বিচারমন্ত্রীতথ্যমন্ত্রী  পরিবেশমন্ত্রী।

Post a Comment

0 Comments